প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আশেপাশের দেশ চাঁদে চলে যায়, আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? ভবিষ্যতে বাংলাদেশও চাঁদে যাবে।’ বর্তমান বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো মানুষ দেশে হয়তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অত্যন্ত সাহসী এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
চাঁদকে নিয়ে আমাদের দেশে যে পরিমাণ কবিতা আর গান হয়েছে তার সমকক্ষ অন্য কোনো দেশের সাহিত্যে রচিত হয়েছে কি না তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে ঈদের সময় ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’র চাঁদ দেখার ঘোষণা ছাড়া অন্য কোনো সময়ে চাঁদের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ সীমিত। কিন্তু, সাম্প্রতিককালে এই পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত।
২০২৩ সালের আগস্টে ভারতের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইসরো তাদের মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩-কে চাঁদের বুকে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়। এটি নানান দিক থেকেই ভারতের জন্য অনন্য এক অর্জন। প্রথমত, ভারতের আগে কেবলমাত্র তিনটি দেশ ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন ) চাঁদে মহাকাশযান সফলভাবে অবতরণ করাতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে হিমায়িত পানি থাকার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকে বলে আসছেন, সেই অঞ্চলেই বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে ভারত চন্দ্রযান-৩-কে অবতরণ করাতে সক্ষম হয়।
শুধু তাই নয়, এই অভিযানে ভারত সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং মাত্র ৬১৫ কোটি ভারতীয় রুপি খরচ হয়। একটি যুগান্তকারী সফল মহাকাশ অভিযান হিসেবে এই প্রকল্প অত্যন্ত সাশ্রয়ী। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিককালে হলিউডের ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বার্বি’র নির্মাণে যা খরচ হয়েছে, তার অর্ধেক লেগেছে এই মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করতে।
সারা বিশ্বেই এই খবর আলোড়ন তৈরি করে। স্বাভাবিকভাবেই সেই আলোচনার ঢেউ লাগে আমাদের বঙ্গীয় ব-দ্বীপেও।
প্রাথমিকভাবে অভিনন্দন এবং প্রশংসা দিয়ে আলোচনা শুরু হলেও খুব শিগগির সেই আলোচনা মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। হঠাৎ করেই আমরা আবিষ্কার করি, আমাদের দেশেও একটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আছে যার নাম বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন বা স্পারসো। সাথে সাথেই ইসরোর সাফল্যের চেয়ে স্পারসোর ব্যর্থতার আলোচনা আমাদের দেশে বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
আলোচনার পরের ধাপে আসে স্পারসোর চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদের নাম। খুঁজে বের করা হলো যে, আব্দুস সামাদ কোনো মহাকাশ বিজ্ঞানী নন বরং বিসিএস (প্রশাসন) পঞ্চদশ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। শিক্ষা জীবনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
দেশের সদ্যোজাত মহাকাশপ্রেমীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ক্ষোভের উদ্গিরণ ঘটাতে শুরু করে এবং সরকার যখন আব্দুস সামাদকে স্পারসোর চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্য পদে পদায়িত করে, তখন এক প্রকার চন্দ্রজয়ের অনুভূতি নিয়ে তারা ক্ষান্ত হন। ধীরে ধীরে এই বিষয়ক আলোচনা স্তিমিত হয়ে পড়ে। ঠিক এমন সময়েই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য তাই বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
মহাকাশ গবেষণা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ আর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, ইসরো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দীর্ঘ ৬০ বছরে এই পর্যন্ত চেয়ারম্যানের পদের দায়িত্ব সামলেছেন কেবলমাত্র দশজন বিজ্ঞানী। গড়ে একজন চেয়ারম্যান ছয় বছর সময় পেয়েছেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। আর স্পারসো প্রতিষ্ঠার পর ৪৩ বছরে মোট চেয়ারম্যান ছিলেন ২৬ জন। অর্থাৎ, একজন চেয়ারম্যান গড়ে মাত্র দেড় বছরের কিছু বেশি সময় পেয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই, এত অল্প সময়ে বড় কোনো কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ বা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এছাড়া কোনো মহাকাশযান তৈরি এবং উৎক্ষেপণের জন্য যে ধরনের জনবল বা অবকাঠামো দরকার তার খুব সামান্যই স্পারসো অর্জন করতে পেরেছে।
তবুও প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন ‘ভবিষ্যতে বাংলাদেশও চাঁদে যাবে’ সেই কথাকে হালকা করে নেওয়ার সুযোগ নেই। ২০১২ সালের জুলাই মাসে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করবে বাংলাদেশ তখন নানান প্রান্ত থেকে সমালোচনা ছুটে এসেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ইস্পাত কঠিন মনোবল আর যোগ্য নেতৃত্বের কারণে ঠিক দশ বছর পর পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়।
ড. মো. মেহেদী হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়