ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এখানে শীত নানা মাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়, যার প্রভাব পড়ে আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিভিন্ন জেলায় এখন শীতের প্রকোপ বেড়েছে। ২ জানুয়ারি উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই সময় বাতাসে আর্দ্রতা ছিল ৯৫ ভাগ। এটিই জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
করোনার নতুন ধরন জেএন.১ (JN.1) আবার দেশের মধ্যেও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এখন বিশ্বে যত করোনা হচ্ছে তার প্রায় ৪৪ শতাংশই এই নতুন ধরন দ্বারা সংঘটিত… একদিকে শীতে তাপমাত্রা কমে, অন্যদিকে বৃষ্টিপাত কমে মাঠঘাট শুকিয়ে ধূলিধুসরিত হয় প্রকৃতি। বেড়ে যায় রোগের সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। বায়ু দূষণ বাড়তে থাকে, চোখে ছানি পড়ার মতো দৃষ্টি সীমায় স্থির হয়ে থাকে অস্বস্তিকর স্মোক।
শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য শীতকাল বিভীষিকার মতো। বায়ু দূষণের শীর্ষ নগরী ঢাকার স্মোক তাদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই বিভীষিকা। বায়ু দূষণের জন্য সম্প্রতি বেশ কয়েকদিন ভারতের দিল্লিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। তবে ঢাকার বায়ুমানও দিল্লির কাছাকাছি দূষিত, দিল্লি প্রথম হলে ঢাকা পঞ্চম।
কেবল ঢাকা নয় বাংলাদেশের বায়ুমান কোনোখানেই তেমন আশাব্যঞ্জক নয়, ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দূষণও যেমন বহু নগরকে টেক্কা দেয়। বায়ু দূষণকে এত প্রাধান্য দেওয়ার কারণ হচ্ছে শ্বাসকষ্ট বা সিওপিডি (Chronic Obstructive Pulmonary Disease-COPD)-এর বাড়বাড়ন্তের খবর।
গোটা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, মৃত্যুও আনুপাতিক হারে বাড়ছে। অসংক্রামক প্রধান চারটি রোগের মধ্যে একটি সিওপিডি। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১২ শতাংশ জনগণ সিওপিডিতে ভুগছে।
মনে রাখতে হবে, শুধু বাইরের বায়ু দূষণ নয় ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণও শ্বাসকষ্ট এবং এ কারণে মৃত্যুর জন্য সমানভাবে দায়ী। রান্নায় কমবেশ সকল রান্নাঘরের বায়ু দূষিত হয়, তবে জ্বালানি ব্যবহারের ওপর বায়ু দূষণের মাত্রা নির্ভর করে। গ্রামের রান্নাঘরে ব্যবহৃত বেশিরভাগ জ্বালানি অনেক দূষণ করে থাকে।
শীতকালে শুধু অসংক্রামক রোগ বা শ্বাসকষ্ট হয় তা নয়, অন্যান্য আরও নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে এবং তাতে মৃত্যুও হচ্ছে। এর মধ্যে শৈত্যপ্রবাহজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু, শ্বাসনালির সংক্রমণ, বাহকজনিত রোগ, অপুষ্টি, ডায়রিয়া অন্যতম।
নানা ধরনের শ্বাসনালির সংক্রমণ হয়ে থাকে। একদিকে যেমন ঊর্ধ্ব শ্বাসনালির সংক্রমণ হয় তেমনি নিম্ননালির সংক্রমণ বা নানা ধরনের নিউমোনিয়া হয়। এই নিউমোনিয়া নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসে সংঘটিত। কোনো কোনো অঞ্চলে মহামারি আকারে নবজাতকদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে।
২০২৩ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে করোনা ৮ গুণ বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে করোনার মূল প্রাদুর্ভাব ঘটে গ্রীষ্মকালে তাই আমাদের করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি কার্যক্রম শুরু করা দরকার, যাতে এই রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখা যায়।
২০২৩ সালে ডেঙ্গু সারা দেশে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩,২১,০৭৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ১৭০৩ জন মারা গেছেন, যা ২০০০ সাল থেকে আক্রান্ত মোট রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যেসব চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয় তাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে ভূমিকা তাতে সন্দেহের জায়গা রয়ে গেছে। সমাধান আর হয়নি। তবুও ২০২৪ সালটা আমাদের জন্য নিরাপদ হোক সেইটাই কামনা।
অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ – প্রাক্তন পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর