অভিবাসন সংক্রান্ত আইনের নানা দিক

অভিবাসন

অভিবাসী কর্মী হলেন এমন ব্যক্তি যিনি কাজের জন্য নিজ দেশে বা এর বাইরে অভিবাসন বা স্থানান্তরিত হন। তাদের প্রবাসী বা অতিথি কর্মীও বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১৬৯ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক অভিবাসী আছে এবং অ-নথিভুক্ত অভিবাসী বা দাসের সংখ্যা রয়েছে অগণিত।

প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে যায়। তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বৈষম্য এবং আইনি সমস্যা ও অসুবিধা থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু নীতিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আইনও প্রণয়ন করেছে।

‘বাংলাদেশ বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন, ২০১৩’ প্রণয়নকল্পে বাংলাদেশ কর্তৃক অণুসমর্থিত ‘International Convention on the Protection of the Rights of All Migrant Workers and Members of Their Families, 1990’ এবং শ্রম ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক অন্যান্য সনদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে আগের ‘অভিবাসন অধ্যাদেশ, ১৯৮২’ রহিত করার মাধ্যমে এই আইনটি নতুন আইন হিসেবে প্রণয়ন করা হয়।

মূল উদ্দেশ্য, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত অভিবাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং সব অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা।

এই আইনের প্রধান বিষয়বস্তু হলো- অভিবাসী কর্মী প্রেরণ, অভিবাসন, অভিবাসী কর্মীর নিবন্ধন এবং বহির্গমন ছাড়পত্র, রিক্রুটিং এজেন্টের দায়-দায়িত্ব। লাইসেন্স প্রাপ্তি, কর্মসংস্থান চুক্তি, শ্রম কল্যাণ উইং এবং অভিবাসন বিষয়ক চুক্তি, অভিবাসী কর্মীর অধিকার এবং দায়-দায়িত্ব, অপরাধ, দণ্ড ও বিচার ইত্যাদি।

‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি, ২০১৬’ এবং ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি, ২০০৬’ রহিতক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (সুযোগের সমতা), ২০ (অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম) এবং ৪০ (পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদ সমূহের আলোকে এই নীতি প্রণয়ন করা হয়, যার মূল উদ্দেশ্য অভিবাসীদের কল্যাণ নিশ্চিত করা।

বর্তমান নীতির কাঠামো ছয়টি প্রধান উদ্দেশ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা—নারী ও পুরুষের জন্য স্বাধীনভাবে এবং নিরাপত্তা ও মানবিক মর্যাদা নিয়ে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি; আন্তর্জাতিক শ্রম-মানদণ্ড ও আইনি দলিলের সাথে সঙ্গতি বজায় রেখে দেশীয় আইন ও বিধি-বিধানের প্রয়োগের মাধ্যমে অভিবাসন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা প্রদান করা, তাদের ক্ষমতায়ন ও সব স্তরে অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা, নারীকর্মী বৈষম্য বিরোধী এবং নিরাপদ ও শোভন বৈদেশিক কর্মসংস্থানে জেন্ডার-সমতা নিশ্চিত করা; শ্রম অভিবাসন নীতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শ্রম বিষয়ক জাতীয় নীতি সমূহের মধ্যে অধিকতর সঙ্গতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রম অভিবাসনকে জাতীয় উন্নয়ন ও পরিকল্পনা কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা এবং শ্রম অভিবাসন পরিচালনার জন্য একটি দক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচালন-কাঠামো প্রবর্তন করা।

‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন, ২০১৮’ বাংলাদেশ কর্তৃক অণুসমর্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও সনদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণক্রমে প্রবাসী ও তাদের ওপর নির্ভরশীলদের সুরক্ষা ও কল্যাণ সাধনে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে বোর্ডের কার্যাবলী, তহবিল, হিসাব রক্ষণ ও নিরীক্ষাসহ নারী অভিবাসী কর্মীদের কল্যাণে বোর্ড কর্তৃক বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে বলা হয়েছে।

এছাড়া ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আইন,২০১৮’-এর মাধ্যমে ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড’ একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই বোর্ডের ভিশন এবং মিশন হলো প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের জন্য অর্থবহ কল্যাণ নিশ্চিত করা। এছাড়া তাদের আইনগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সার্বিক কল্যাণ সাধন করা, বিদেশে প্রত্যাগত কর্মীদের পুনর্বাসনে সহায়তা করা, তাদের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা, তাদের বীমার আওতায় আনা এবং প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তাসহ জীবনমানের উন্নয়নে সাহায্য করা।

কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত রেমিট্যান্স দেশের উন্নয়ন তথা অর্থনীতিতে বিরাট অবদানের বিষয়টি বিবেচনা করে, তাদের পরিবার পরিজনকে সাহায্য সহযোগিতাসহ সার্বিক কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে সরকার ১৯৯০ সালে ‘ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল’ গঠন করে।

প্রণয়ন করা হয় মানব পাচার প্রতিরোধসহ এই অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করাসহ নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার জন্য ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’। এবং মানব পাচার সংক্রান্ত সংঘবদ্ধভাবে সংঘটিত আন্তঃদেশীয় অপরাধ সমূহ প্রতিরোধ ও দমনকল্পে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিধান করা প্রয়োজন।

সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে একটি হলো জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের সুরক্ষা এবং ৩৪ অনুচ্ছেদে সব ধরনের জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা বেশিরভাগ সময় মানব পাচারের অনিবার্য পরিণতি। মানব পাচার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারের উচিত এই আইনের বিধানগুলো সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করা।

‘মহিলা অভিবাসন সুরক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ সার্কুলার’-নামে নারী অভিবাসীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক নারী গৃহকর্মী বা গৃহস্থালির কাজ হিসেবে শ্রম অভিবাসনে প্রবেশ করে এবং প্রায় ক্ষেত্রে তারা পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার অভাব, নিম্ন বেতন স্কেল, পতিতাবৃত্তি এবং শোষণ, পাচার, ধর্ষণ, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন ইত্যাদির শিকার হন।

তাই নারী কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’ বিশেষ সার্কুলারে জারি করেছেন যেখানে বলা আছে—নারী শ্রমিকের বয়স বাড়িয়ে বা কমিয়ে অথবা মেডিকেল চেক ব্যতিরেকে প্রেরণ করলে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিদেশে যাওয়ার পূর্বে ৩০ দিন মেয়াদের প্রশিক্ষণ মূল্যায়নে তৃতীয় পক্ষের রায় এবং কর্মচুক্তির শর্তগুলো বাংলায় অনুবাদ করে পড়ে শোনানোসহ স্মার্ট মোবাইল প্রদান করতে হবে।

প্রত্যাগত নারী কর্মীর তালিকা, ফ্লাইট নং -ইত্যাদি শ্রমকল্যাণ উইং বিমান বন্দর, কল্যাণ ডেস্ক এবং রিক্রুটিং এজেন্সিকে পূর্বেই অবহিত করাসহ বিমানবন্দরের কাছাকাছি রি-ইন্টিগ্রেশন সেল স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়া অভিবাসীদের সার্বিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’। যার মিশন এবং ভিশন হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ ও অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, অভিবাসন ব্যয় হ্রাসসহ অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।

মাহমুদুল ইসলাম শাকিল, শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট

আরও দেখুন

এ সংক্রান্ত আরও পড়ুন